সোনার দাম যেন এক লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটছে। ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙে মূল্যবান এই ধাতু পৌঁছে গেছে নতুন উচ্চতায়। কিন্তু কেন এই দাম বাড়ছে? এই মূল্যবৃদ্ধি কি কেবল সাধারণ চাহিদা-সরবরাহের ফল, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর কোনো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চালক, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারের কাঠামোগত দুর্বলতা?
সোনার মূল্য বৃদ্ধির কারণগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি আর সাধারণ গহনার চাহিদা বা যোগানের ওপর নির্ভর করছে না। বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন সোনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ (Safe Haven) এবং ‘মূল্য সংরক্ষণের মাধ্যম’ (Store of Value) হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের বাজারে এই দাম সমন্বয় করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস), যারা আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সঙ্গতি বজায় রাখতে নিয়মিত দাম বাড়িয়ে থাকে।
এই প্রবন্ধে সোনার দাম বৃদ্ধির নেপথ্যের বৈশ্বিক ও স্থানীয় কারণগুলোর সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।
১. সোনার দাম বৃদ্ধির তিন প্রধান বৈশ্বিক চালক
সোনার দাম মূলত তিনটি শক্তিশালী শক্তির দ্বারা চালিত হয়:
ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক চাপ: মুদ্রাস্ফীতি, ডলার ও সুদের হার
আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার মূল্য নির্ধারণে অর্থনীতির মৌলিক নীতিগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য:
- মুদ্রাস্ফীতি এবং ঐতিহাসিক সুরক্ষা: উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির (Inflation) সময় ফিয়াট মুদ্রার (যেমন টাকা, ডলার) ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা তাদের সম্পদ রক্ষা করতে সোনার দিকে ঝুঁকে। ঐতিহাসিক উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০-এর দশকে তেলের সংকট ও চরম মুদ্রাস্ফীতির সময় সোনার দাম আউন্স প্রতি $৩৫ থেকে $৮৫০ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল, যা ৩০০% এরও বেশি বৃদ্ধি। সোনা ঐতিহ্যগতভাবেই ক্রয় ক্ষমতা সংরক্ষণের সেরা হাতিয়ার।
- মার্কিন ডলারের সঙ্গে বিপরীত সম্পর্ক: আন্তর্জাতিক বাজারে সোনা যেহেতু ডলারে লেনদেন হয়, তাই দুর্বল ডলার সোনার দাম বাড়িয়ে তোলে। ডলার দুর্বল হলে ডলার-বহির্ভূত মুদ্রা ব্যবহারকারী দেশগুলির জন্য সোনা তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে যায়, ফলে এর চাহিদা বাড়ে।
- প্রকৃত সুদের হারের জটিলতা: সোনার কোনো লভ্যাংশ বা সুদ নেই (Non-yielding asset)। যখন প্রকৃত সুদের হার (Real Interest Rate) (নামমাত্র সুদ হার – মুদ্রাস্ফীতি) ঋণাত্মক হয়, তখন সোনা ধরে রাখার সুযোগ ব্যয় কমে যায়। এই ঋণাত্মক RIR সোনাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তোলে, যা এর দাম বাড়িয়ে তোলে। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ভয়ে বিনিয়োগকারীরা বন্ড বিক্রি করে সোনার দিকে গেলে সুদের হার বাড়লেও সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপদ আশ্রয়ের চাহিদা
সাম্প্রতিক সময়ে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত এবং চীন-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধ বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, তা সোনার দামকে চূড়ায় তুলেছে।
ভূ-রাজনৈতিক সংকটের সময় বিনিয়োগকারীরা স্টক বা অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থেকে অর্থ সরিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সম্পদে বিনিয়োগ করে। সোনা অন্যান্য সম্পদ শ্রেণীর সঙ্গে কম সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় (Low Correlation), এটি এক প্রকার বীমা (Insurance) হিসাবে কাজ করে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট বা যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোর পতন (যেমন SVB বা Zions Bancorporation)-এর মতো ঘটনাগুলিতে বিনিয়োগকারীরা সুরক্ষিত আশ্রয়স্থল হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির কৌশলগত ক্রয়: ডি-ডলারাইজেশন
বর্তমানে সোনার দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত কারণ হলো বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির বিপুল পরিমাণ কৌশলগত সোনা ক্রয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি টানা ১৫ বছর ধরে সোনার নিট ক্রেতা। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে তারা প্রতি বছর ১,০০০ টনেরও বেশি সোনা মজুত করেছে, যা আধুনিক রেকর্ড।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি সোনা কেনে কারণ এটি কাউন্টারপার্টি ঝুঁকি মুক্ত। সোনাকে ছাপানো যায় না, এর মূল্য অবমূল্যায়ন করা যায় না, বা এর ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় না। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা ডলার-কেন্দ্রিক হওয়ায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি তাদের রিজার্ভ বহুমুখী করতে চাইছে—যা ডি-ডলারাইজেশন নামে পরিচিত। চীন কৌশলগত কারণেই মার্কিন বন্ড কমিয়ে সোনার মজুত বাড়াচ্ছে। এই প্রাতিষ্ঠানিক ও নিরবচ্ছিন্ন চাহিদা বৈশ্বিক বাজারে সোনার সরবরাহ-চাহিদার গতিশীলতাকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে দিচ্ছে, যা দামের ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি করেছে।
বৈশ্বিক চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা
বিশ্ব গোল্ড কাউন্সিলের (WGC) ডেটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় যাওয়ার পরেও সামগ্রিক চাহিদা কমে যায়নি, বরং চাহিদার কাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে।
| খাত (Sector) | Q2’25 চাহিদা (টন) | বার্ষিক পরিবর্তন (% y/y) | দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা |
| মোট বিনিয়োগ (Investment) | ৪৭৭.২ | +৭৮% | অত্যন্ত শক্তিশালী প্রধান চালক |
| গহনা ভোগ (Jewellery Consumption) | ৩৪১.০ | -১৪% | উচ্চ মূল্য সংবেদনশীলতার কারণে হ্রাস |
| কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রয় (Central Banks) | ১৬৬.৫ | -২১% | দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত স্থিতিশীলতা প্রদানকারী |
| প্রযুক্তি (Technology) | ৭৮.৬ | -২% | তুলনামূলকভাবে কম প্রভাব |
| মোট চাহিদা (Total Demand) | ১,২৪৮.৮ | +৩% | রেকর্ড মূল্যকে সমর্থন করে |
উৎস: বিশ্ব গোল্ড কাউন্সিল রিপোর্ট (Q2’25)
এই সারণী থেকে স্পষ্ট যে, রেকর্ড উচ্চ দামের কারণে গহনা খাতের চাহিদা ১৪% হ্রাস পেলেও, বিনিয়োগ খাত থেকে আসা ৭৮% বিশাল চাহিদা সেই ঘাটতি পূরণ করে দামকে আরও উপরে ঠেলে দিয়েছে। বার, কয়েন এবং গোল্ড-ব্যাকড ইটিএফ (ETFs) বিনিয়োগকারীরাই এখন দামের মূল নিয়ন্ত্রক।
অন্যদিকে, সরবরাহ খুব ধীর গতিতে বেড়েছে। ২০২৪ সালে খনি উৎপাদন নতুন রেকর্ডে পৌঁছালেও, মোট সোনার সরবরাহ মাত্র ১% বৃদ্ধি পেয়েছিল। পুনর্ব্যবহৃত সোনার সরবরাহ ১১% বাড়লেও তা ২০১২ সালের সর্বোচ্চ স্তরের চেয়ে অনেক কম ছিল। অর্থাৎ, বিপুল চাহিদার তুলনায় সরবরাহ খুবই কম, যা দাম বাড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে দাম বৃদ্ধির নেপথ্যের কারণ
বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে সোনার দাম বাড়ার পেছনে দুটি প্রধান স্থানীয় কারণ জড়িত:
ডলার সংকট ও টাকার অবমূল্যায়ন
স্থানীয় বাজারে সোনার দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণগুলির মধ্যে একটি হল টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি এবং সংকট। সোনা যেহেতু ডলারে কেনা আন্তর্জাতিক পণ্য, তাই যখন বিশ্ববাজারে এর দাম বাড়ে, তখন টাকার ওপর চাপ আসে। এর ওপর, যখন দেশীয় বাজারে ডলারের মূল্য (যেমন ১১৮ টাকা পর্যন্ত) অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখন দেশীয় মুদ্রায় সোনার দাম অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক দাম স্থির থাকলেও ডলারের দাম বাড়ার কারণে দেশীয় বাজারে দাম বেড়ে যায়, যা স্থানীয় অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
লাগামহীন সোনা চোরাচালান ও অর্থনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)-এর দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশের বাজারে মূল্য বৃদ্ধির এক বড় কাঠামোগত দুর্বলতা হলো ব্যাপক সোনা চোরাচালান।
- বিশাল আর্থিক ক্ষতি: বাজুসের দাবি, প্রবাসী শ্রমিকদের বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সোনা বাংলাদেশে আসছে। বছর শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
- ডলার রিজার্ভের ওপর চাপ: এই প্রক্রিয়ায় বড় অঙ্কের ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা দেশের ডলার সংকটের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। প্রবাসীরা ডলারের পরিবর্তে সোনার বার কিনে দেশে নিয়ে আসছে এবং এই সোনা পরবর্তীতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
- কৃত্রিম সংকট: চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেট স্থানীয় পোদ্দার (পাইকারি) বাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে স্থানীয় সোনার দাম বাড়াচ্ছে।
এই চোরাচালান ঠেকাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা করতে সরকার ব্যাগেজ রুলে কড়াকড়ি এনেছে। আগে যতবার খুশি শুল্ক ছাড়া ১০০ গ্রাম সোনার গয়না আনা গেলেও, এখন সেই সুযোগ বছরে একবারের মধ্যে সীমিত করা হয়েছে।
বাজারের পূর্বাভাস ও নীতিগত সুপারিশ
সোনার দামের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আপাতত বজায় থাকার সম্ভাবনা বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির ক্রমাগত ক্রয়, ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি, এবং যুক্তরাষ্ট্রে সম্ভাব্য সুদহার কমানোর পূর্বাভাস হলুদ ধাতুর দামকে সমর্থন জোগাচ্ছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে দামের অস্থিরতা কমানোর জন্য ডলারের মূল্য স্থিতিশীল করা এবং চোরাচালান বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা অপরিহার্য। চোরাচালান রোধে বাজুসকে যুক্ত করে সরকারি মনিটরিং সেল গঠন করা এবং বৈধ উপায়ে সোনা আমদানি প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও নিয়মিত করা দেশের জুয়েলারি শিল্পে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হতে পারে।
সোনার দাম বৃদ্ধি এখন সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার চেয়ে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের ভয়, আস্থার সংকট এবং প্রাতিষ্ঠানিক কৌশলগত সিদ্ধান্তের ওপর বেশি নির্ভরশীল। এই জটিল গতিশীলতাই সোনার মূল্যকে আকাশছোঁয়া করে তুলেছে।

