ঢাকা, বাংলাদেশ – [বর্তমান তারিখ: শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৫] – বাংলাদেশে সোনার দাম ক্রমাগতভাবে নতুন রেকর্ড গড়ছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) দেওয়া সর্বশেষ দর অনুযায়ী, দেশের বাজারে সব ধরনের সোনার মূল্য সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক বুলিয়ন বাজার এবং স্থানীয় অর্থনৈতিক উভয় দিকের চাপেই এই মূল্যবান ধাতুটির মূল্য এমন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।
সংযুক্ত মূল্য তালিকা অনুযায়ী, প্রতি গ্রাম সোনার সর্বশেষ দাম নিম্নরূপ:
বাংলাদেশে সোনার বর্তমান মূল্য (প্রতি গ্রাম, বাজুস অনুযায়ী)
ক্যারেট | দাম (বাংলাদেশী টাকা/BDT) |
---|---|
২২ ক্যারেট | ১৭,৯২৭ টাকা |
২১ ক্যারেট | ১৭,১১২ টাকা |
১৮ ক্যারেট | ১৪,৬৬৮ টাকা |
সনাতন পদ্ধতি | ১২,২০০ টাকা |
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই মূল্যগুলি প্রতি গ্রাম সোনার জন্য ধার্য এবং এর সাথে সরকারের নির্দেশিত ৫% ভ্যাট ও বাজুস নির্ধারিত সর্বনিম্ন ৬% মজুরি (মেকিং চার্জ) অন্তর্ভুক্ত নয়। গয়নার ডিজাইন ও কারুকার্যের ভিত্তিতে মজুরি পরিবর্তন হতে পারে।
এই নতুন মূল্য নির্ধারণ বাজারের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে, যা গ্রাহক এবং ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
সোনার দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণসমূহ
’সোনা বাংলাদেশ’ খাতে এমন লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু শক্তিশালী অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে:
১. আন্তর্জাতিক বুলিয়ন বাজারের অস্থিরতা
সোনার মূল্য বিশ্বব্যাপী মার্কিন ডলারে নির্ধারিত হয়। বৈশ্বিক অস্থিরতা বাড়লে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি কমাতে ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকতে থাকেন। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো:
- ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা: বিশ্বজুড়ে চলমান সংঘাত এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সোনার চাহিদা বৃদ্ধি করছে।
- মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের নীতি: বিশ্বজুড়ে সুদের হার কমানোর জল্পনা-কল্পনা সোনা-কে বন্ড বা সঞ্চয়ের চেয়ে অধিক লাভজনক বিনিয়োগে পরিণত করেছে।
২. টাকার অবমূল্যায়ন ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি
দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকা (BDT)-এর অব্যাহত দরপতন। সোনা বৈধ বা ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে যেভাবেই আমদানি হোক না কেন, তা বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। টাকার মান কমায় আমদানি খরচ সরাসরি বৃদ্ধি পায়, যা স্থানীয় সোনার দামে প্রতিফলিত হয়।
৩. চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা
দাম এত বাড়লেও গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের চাহিদা এখনো উল্লেখযোগ্য। বিবাহের মরসুম সামনে রেখে সোনার চাহিদা বিশেষভাবে বাড়ে। বৈধ পথে সোনার আমদানি সীমিত হওয়ায় এবং স্থানীয় বাজারে তীব্র ঘাটতি থাকায় একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে পূরণ হয়, যা স্থানীয় বাজারে আন্তর্জাতিক মূল্যের চেয়ে উচ্চ মূল্য চাপিয়ে দেয়। এই অতিরিক্ত মূল্য সোনা-কে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রিমিয়াম সম্পদে পরিণত করেছে।
গ্রাহক ও শিল্পে প্রভাব
রেকর্ড-ভাঙা এই মূল্য বাংলাদেশে সোনার বাজারকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছে:
- বিনিয়োগের আকর্ষণ বৃদ্ধি: বিনিয়োগকারীদের জন্য, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন মোকাবিলার জন্য সোনা একটি অপরিহার্য রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকে সম্পদ সংরক্ষণের জন্য গোল্ড বার ও কয়েন কেনার দিকে ঝুঁকছেন।
- বিক্রিতে মন্দা: সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের জন্য, উচ্চ মূল্য ও এর সাথে যুক্ত মেকিং চার্জ সোনার গয়না কেনা কঠিন করে তুলেছে। জুয়েলার্সরা খুচরা বিক্রিতে মন্দার খবর দিচ্ছেন।
সোনার বাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক চাপ বিদ্যমান থাকায় বাংলাদেশে সোনার দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় থাকবে। যতক্ষণ আন্তর্জাতিক অস্থিরতা এবং টাকার উপর চাপ থাকবে, সোনা তার মূল্য সংরক্ষণের ক্ষমতা ধরে রাখবে।
সোনার ক্রেতাদের জন্য পরামর্শ হলো, বাজুসের দৈনিক মূল্য পরিবর্তনের দিকে খেয়াল রাখা এবং কেনার আগে সরকারি ভ্যাট ও মেকিং চার্জের বিষয়টি সঠিকভাবে বিবেচনা করে নেওয়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে সোনা শুধু অলঙ্কার নয়, অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুখে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক উপকরণ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।