দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন ডলার বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। ব্রেটন উডস চুক্তি (১৯৪৪), এবং পরবর্তীকালে তেলের বাণিজ্যে ডলারের বাধ্যতামূলক ব্যবহার (Petrodollar System) এই মুদ্রাকে “বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা”র আসনে বসিয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০%-এরও বেশি এবং বৈশ্বিক রিজার্ভের প্রায় ৬০% (তথ্যসূত্র: আইএমএফ ও বিআইএস) ডলারে লেনদেন হয়।
এই একচেটিয়া আধিপত্য আমেরিকাকে তার বিশাল বাজেট ঘাটতি কম সুদে মেটানোর এবং তার পররাষ্ট্র নীতিতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা ‘স্যাংশনস’-এর মাধ্যমে এক অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিয়েছে।
কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমেরিকার ক্রমবর্ধমান ঋণ (যা $34 ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে), এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে ডলারের এই অপ্রতিরোধ্যতা চ্যালেঞ্জের মুখে। ডলারের পতন ঘটলে তা কেবল আমেরিকার সমস্যা থাকবে না, বরং তা বিশ্বজুড়ে এক মহা-আর্থিক ভূমিকম্প ঘটাবে। একজন আর্থিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে, এখানে সেই সম্ভাব্য প্রভাব, বিকল্প মুদ্রার বিশ্লেষণ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. আমেরিকার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস
ডলারের পতন মানেই হচ্ছে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় আমেরিকার অর্থনীতির প্রতি আস্থা ভেঙে যাওয়া।
- কমবে বাণিজ্যিক শক্তি: রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মর্যাদা হারালে আমেরিকা সস্তায় ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা হারাবে। বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন ডলারে না হলে, মার্কিন পণ্যের চাহিদা ও আন্তর্জাতিক বাজারে তার প্রতিপত্তি কমবে।
- ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারানো: ডলারের মাধ্যমে আমেরিকা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে। রাশিয়া এবং ইরানের মতো দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞায় ডলারের ব্যবহারই মূল অস্ত্র। ডলারের বিকল্প তৈরি হলে, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকারিতা হারাবে, যার ফলে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আমেরিকার প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।
বিশ্লেষণ: যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের দ্রুত বৃদ্ধি (Debt-to-GDP Ratio বৃদ্ধি) বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই ঋণের মাত্রা যত বাড়বে, ডলারের স্থিতিশীলতা নিয়ে তত বেশি প্রশ্ন উঠবে, যা ‘ডি-ডলারাইজেশন’ প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত করতে পারে।
২. বিকল্প মুদ্রার উত্থান এবং বহুমুখী আর্থিক ব্যবস্থা (Multipolarity)
ডলারের দুর্বলতা অন্যান্য বড় অর্থনৈতিক শক্তিকে তাদের নিজস্ব মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরার সুযোগ দেবে।
বিকল্প মুদ্রা | বর্তমান শেয়ার (আনুমানিক) | ডলারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কারণ |
ইউরো (Euro – €) | বৈশ্বিক রিজার্ভে প্রায় ২০% | ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্মিলিত অর্থনৈতিক শক্তি; ডলারের প্রধান এবং দীর্ঘদিনের বিকল্প। |
ইউয়ান (Yuan / RMB – ¥) | বৈশ্বিক রিজার্ভে ২% থেকে ৩% | চীন বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক শক্তি; BRICS জোটের মাধ্যমে ইউয়ানকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা। |
সোনা (Gold – 🥇) | বৈশ্বিক রিজার্ভে ক্রমবর্ধমান | ঐতিহ্যবাহী ‘সেফ হেভেন’ সম্পদ; যেকোনো রাজনৈতিক ও আর্থিক অস্থিরতায় এর মান অক্ষুণ্ণ থাকে। |
- BRICS-এর ভূমিকা: ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত BRICS জোট নিজস্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় ডলার বাদ দিয়ে স্থানীয় মুদ্রা বা একটি অভিন্ন মুদ্রা ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। এই পদক্ষেপ ডলারের আধিপত্যে সরাসরি আঘাত হানবে।
- চীনের ইউয়ানের সম্প্রসারণ: চীন, রাশিয়া এবং সৌদি আরবের মতো বড় অর্থনীতির সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ইউয়ানের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। যদিও ইউয়ান এখনও মুক্তভাবে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা নয়, তবে এর রিজার্ভের অংশীদারিত্ব ধীরে ধীরে বাড়ছে।
৩. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা ও চরম মুদ্রাস্ফীতি (Hyper-Inflation)
ডলারের পতন হলে এর সবচেয়ে বড় শিকার হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য।
- রিজার্ভের মূল্যহ্রাস: বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার রিজার্ভের মূল্য রাতারাতি কমে যাবে। এর ফলে অনেক দেশের জাতীয় সম্পদের পরিমাণ হঠাৎ করে কমে যাবে, যা গুরুতর আর্থিক সংকটের সৃষ্টি করবে।
- আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি: তেল, গ্যাস ও অন্যান্য প্রধান পণ্য যেহেতু ডলারে কেনা-বেচা হয়, তাই ডলারের মূল্যহ্রাস ঘটলে অন্যান্য দেশের স্থানীয় মুদ্রায় আমদানি খরচ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে। এর ফলে আমদানিনির্ভর দেশগুলোতে (যেমন বাংলাদেশ) চরম মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) দেখা দেবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।
- ঋণ পরিশোধের চাপ: উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি বড় অংশ ডলারে ঋণ নিয়েছে। ডলারের পতন ঘটলে, বিকল্প মুদ্রার বিপরীতে এর বিনিময় হার অস্থির হয়ে উঠবে। যদিও তাত্ত্বিকভাবে ডলারের মূল্য কমলে ঋণ পরিশোধ সহজ হতে পারে, কিন্তু বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলার ফলে স্থানীয় মুদ্রারও পতন ঘটে, যা ঋণ পরিশোধের চাপকে আরও বাড়াতে পারে।
৪. সোনার দাম কেন আকাশচুম্বী হবে? (The Golden Buffer)
ডলারের পতন হলে সোনাকে ‘আসল টাকা’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, যা এর মূল্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
- নিরাপদ বিনিয়োগের আশ্রয়: বিশ্ব যখন আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে, তখন বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি এড়িয়ে সোনার মতো স্থিতিশীল সম্পদে বিনিয়োগ করে। ডলারের দুর্বলতা এই প্রবণতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য (Data Analysis): ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (WGC)-এর তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের সোনা রিজার্ভ কেনার পরিমাণ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাড়িয়েছে।
- ২০২২-২০২৩: কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যথাক্রমে ১,০৮২ টন ও ১,০৩৭ টন সোনা কিনেছে, যা এক দশকের গড় কেনার পরিমাণের দ্বিগুণেরও বেশি।
- কারণ: ভূ-রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা (বিশেষ করে রাশিয়ার রিজার্ভ জব্দ হওয়ার পর) এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য দেশগুলো ডলারের বন্ড থেকে সোনায় সরে আসছে।
- দাম বৃদ্ধির পূর্বাভাস: অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ডলারের দুর্বলতা বজায় থাকলে অদূর ভবিষ্যতে প্রতি আউন্স সোনার দাম $4,000 বা তারও বেশি ছাড়িয়ে যেতে পারে (যেমনটা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর উল্লম্ফন দেখে অনুমান করা হচ্ছে)।
৫. বৈশ্বিক প্রস্তুতি ও ভবিষ্যৎ কৌশল (Global Preparedness)
বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতিগুলো ডলারের পতন ঘটার আগেই নিজেদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৌশল নিচ্ছে:
দেশ/জোট | প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ | অর্থনৈতিক তাৎপর্য |
🇨🇳 চীন | ধারাবাহিকভাবে সোনা রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে ইউয়ানের ব্যবহার সম্প্রসারণ। | ডলারের আধিপত্য কমাতে এবং ইউরো-ইউয়ান-কেন্দ্রিক একটি নতুন আর্থিক ব্লক তৈরি করতে চাইছে। |
🇷🇺 রাশিয়া | ডলার ও ইউরো রিজার্ভের ব্যবহার দ্রুত কমিয়ে সোনা এবং নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে। | পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মোকাবিলা করতে ‘স্যাংশন-প্রুফ’ সম্পদ ও বাণিজ্য পথ তৈরি। |
🇮🇳 ভারত | সোনা রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং রাশিয়া, আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর সাথে রুপিতে (INR) বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ। | আমদানি-নির্ভরতা কমাতে এবং নিজস্ব মুদ্রার আন্তর্জাতিকীকরণ করতে চাইছে। |
🇧🇷 BRICS জোট | আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য একটি বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম এবং সম্ভবত একটি অভিন্ন মুদ্রা তৈরির আলোচনা। | পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত SWIFT পেমেন্ট সিস্টেম ও ডলারের বিকল্প তৈরি। |
উপসংহার: অনিবার্য পরিবর্তন এবং টিকে থাকার কৌশল
ডলারের পতন রাতারাতি ঘটবে না। বিদ্যমান আর্থিক অবকাঠামো, মার্কিন অর্থনীতির বিশাল আকার এবং স্থিতিশীলতা (এখনও পর্যন্ত) ডলারের আধিপত্য ধরে রেখেছে। তবে, বৈশ্বিক অর্থনীতি ধীরে ধীরে একটি বহুমুখী কাঠামোর দিকে এগোচ্ছে, যেখানে ইউরো, ইউয়ান এবং অবশ্যই সোনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই পরিস্থিতিতে, যে দেশগুলো তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বৈচিত্র্য আনবে এবং বিশেষ করে সোনা মজুত বাড়াবে, তারাই ভবিষ্যতে আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকবে। বিনিয়োগকারী এবং নীতিনির্ধারক উভয়ের জন্যই ডলারের ভবিষ্যতের এই ঝুঁকিগুলো বিশ্লেষণ করে কৌশলগত প্রস্তুতি নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
(Disclaimer: এই বিশ্লেষণটি বাজারের তথ্য ও অর্থনৈতিক মডেলের ভিত্তিতে করা হয়েছে এবং এটি কোনো বিনিয়োগের পরামর্শ নয়।)